বর্তমান সময়ে ছেলেদের ক্রিকেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে মেয়েদের ক্রিকেটও। তবে মেয়েদের ক্রিকেটের অর্জনের দিকে তাকালে বড় সাফল্য চোখে পড়ে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের বারের মতো এশিয়া কাপ জয় করে মেয়েরা। যেটি এখনো সাকিব-তামিমরা অর্জন করতে পারেননি। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছেলেদের ক্রিকেটের যাত্রা অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সেই মেয়েদের ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। এই অল্প সময়ে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছেন রুমানা-জ্যাতিরা। ক্রিকেট অঙ্গনে নারীরা এগিয়ে গেলেও তারা সুযোগ-সুবিধার বেলায় অনেক পিছিয়ে। এমনকি ক্রিকেটার তৈরির যে পাইপ লাইন অর্থাৎ নারী ক্রিকেট একাডেমি, সেটিও তৈরিতে অনীহা ঢাকার একাডেমিগুলোর।
ঢাকাসহ দেশের ক্রিকেট একাডেমিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এর গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ। সংস্থাটির ২০১৯ সালের তথ্যমতে, বিসিবির তালিকাভুক্ত ক্রিকেট একাডেমি রয়েছে ৮২টি। এ একাডেমিগুলো ঢাকা মেট্রোপলিটনের অধীনে। এখান থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্রিকেটার নেয় বিসিবি।
জানা যায়, ঢাকা মেট্রো ক্রিকেট টুর্নামেন্টের জন্য ২০২০ সালে করোনার মধ্যে সাড়ে আটশোর মতো ক্রিকেটারের ভিডিও নিয়েছিল গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে পাঁচশোজনকে বাছাই করা হয়েছে। মেডিকেল পরীক্ষার পর এই ক্রিকেটারদের থেকে আটটি করে দল গড়া হয়েছিল টুর্নামেন্টের জন্য। শুধু আসরের জন্যই নয়, নানা সময়ে এই একাডেমিগুলো ক্রিকেটার সরবরাহ করে বিকেএসপিকে দেয়। যেখানে থেকে গড়া হয় বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল। ফলে বলা যায় ঢাকার এই একাডেমিগুলো বিসিবির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব একাডেমির মধ্যে মেয়েদের জন্য একক একাডেমি নেই। কিংবা মেয়েদের জন্য আলাদা শাখাও নেই।
পরিসংখ্যান বলছে, ৮২টি একাডেমির মধ্যে মাত্র তিনটি একাডেমি নারী ক্রিকেটাদের নিয়ে কাজ করে। তারা হলো- খেলাঘর ক্রিকেট একাডেমি, ইন্দিরা রোড ক্রিকেট একাডেমি ও শিশুকিশোর ক্রিকেট একাডেমি। বাকি একাডেমিগুলোতে নারী ক্রিকেটার নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকলেও তারা তেমন করে না। কিছু একাডেমি শুধু ছেলেদের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করে। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমি, গোল্ডেন বয়েজ ক্রিকেট একাডেমি, মোহাম্মদপুর ক্রিকেট একাডেমি অন্যতম।
এদিকে, নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি থাকা দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিক শিকারি ও অলরাউন্ডার রুমানা আহমেদ। ডেইলি বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি দরকার। অনেক আগে থেকেই এটা আমি অনুভব করি। যারা ঢাকায় থাকেন কিংবা ঢাকার আশপাশে থাকেন, তাদের জন্য সেভাবে কোনো নারী একাডেমি নেই। কিছু একাডেমি রয়েছে, সেখানে একসঙ্গে ছেলে-মেয়েদের অনুশীলন করানো হয়। নারীদের জন্য আলাদা কোনো একাডেমি নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘একটা ছেলে যেখানে-সেখানে অনুশীলন করতে পারে। কিন্তু একটা মেয়ে যেখানে-সেখানে অনুশীলন করতে পারে না। তাদের জন্য আলাদা অনুশীলন স্থান দরকার। এখন মাসকো সাকিব একাডেমি হয়েছে। যেখানে অনেক নারী ক্রিকেটার অনুশীলন করছে। কিন্তু সেটা অনেক দূর। খরচ বেশি। সবাই সেখানে গিয়ে অনুশীলন করতে পারে না। ফলে ঢাকায় যদি মেয়েদের জন্য আলাদা একাডেমি, আলাদা অনুশীলনের স্থান, আলাদা কোচ থাকত, তাহলে আরো ভালো হতো। ভালো নারী ক্রিকেটার তৈরি হতে পারত। জাতীয় দলের পাইপলাইনকে সমৃদ্ধ করত।’
গুলিস্তানে হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের পাশে গড়ে উঠেছে রেইনবো ক্রিকেট একাডেমি। এখানে ২০২১ সালে আলো আক্তার নামে একজন নারী ক্রিকেটার নিয়মিত অনুশীলন করতেন। নারী ঐ ক্রিকেটারকে একাডেমির পক্ষ থেকে ব্যাট-বল এবং একাডেমির খরচ ফ্রি করে দেওয়া হয়েছিল। তিন মাস অনুশীলন করার পর ঐ ক্রিকেটার খো খো ফেডারেশনের খো খো খেলতে (এক ধরনের খেলা) থাকে। পরে ঐ নারী ক্রিকেটার ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গেছেন বলে জানান একাডেমির হেড কোচ হাসান নাঈম।
তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে আগ্রহ নিয়ে এখানে সে খেলতে এসেছিল। কিন্তু আমার একাডেমিতে কোনো নারী ক্রিকেটার না থাকায় সে বেশিদিন এখানে থাকেনি। সে খেলুক। সেজন্য আমরা একাডেমির পক্ষ থেকে ব্যাট, বল, প্যাড সবকিছু ফ্রি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে শুনি সে খো খো খেলবে। সে খো খো খেলে। কারণ হিসেবে সে বলে- একাডেমিতে কোনো নারী ক্রিকেটার নেই। তাছাড়া তাকে ছেলেদের সঙ্গে খেলতে হতো। পরে সে চলে যায়। কিন্তু আমার এখানে আলাদা একাডেমি থাকলে সে থেকে যেত। আবার একজনের জন্য কি করে আলাদা একাডেমি করি?’
ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে বর্তমানে ৯ জন নারী ক্রিকেটার অনুশীলন করেন। তারা সবাই ঐ একাডেমির ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করেন। নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি না থাকা প্রসঙ্গে ঐ একাডেমির সহ-প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মজিদ বলেন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ‘নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি দরকার। কিন্তু যেসব একাডেমি আছে, সেখানে বর্তমানে নারীদের অংশগ্রহণ কম। কম শিক্ষার্থী হওয়ায় অনেক সময় খরচ ওঠে না। এগুলো বিবেচনা করে আমরা ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে অনুশীলন করাই। আমাদের এখানে নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি নেই। তাছাড়া নারী একাডেমি করতে হলে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়, সবকিছু আলদা করতে হবে। যেগুলোর জন্য জায়গার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে জায়গার দাম অনেক। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়ও রয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে অনেক একাডেমি নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি করে না। বর্তমানে যেহেতু নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষত্রে তাদের বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের নিয়ে আমরা কাজ করছি। ভবিষ্যতে নারীদের অংশগ্রহল বাড়লে আলাদা একাডেমি করার পরকিল্পনা রয়েছে আমাদের।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ন্যাশনাল গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার আবু ইমাম মো. কাউসার ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিসিবি এই একাডেমিগুলো ঐভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। কারণ, এগুলো সব প্রাইভেট একাডেমি। আমাদের বিভিন্ন লিগের সময় সেখান থেকে খেলোয়াড় নিয়ে থাকি। ট্রেনিং করিয়ে তাদেরকে আমরা বয়সভিত্তিক দলে নিই।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিসিবি থেকে তাদের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা যেন নারী খেলোয়াড়দের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে। কিন্তু ঐ একাডেমিগুলো নিজস্ব খরচে চলে। বিসিবি থেকে তাদের টাকা-পয়সা দেওয়া হয় না। তাই তারা একসঙ্গে ছেলে-মেয়েদের অনুশীলন করায়। তাদের বলা আছে, সুযোগ থাকলে যেন আলাদাভাবে নারী একাডেমি তৈরি করা হয়। আশার কথা হলো অনেকেই কথা দিয়েছেন- সুযোগ পেলে তারা নারীদের জন্য আলাদা একাডেমি করবেন।’