আমার দেখা এক সুখী দম্পতির কথা বলি। দুই যুগের বেশি সময় তাঁরা কাটিয়েছেন এক ছাদের নিচে। দুজনের কাউকে কারও কাছে কখনো নিজেদের সম্পর্কে বদনাম করতে শুনিনি। কোনো আক্ষেপও টের পাওয়া যায়নি। কখনো কারও কানকথায় তাঁরা কান দেননি। যেকোনো পছন্দ-অপছন্দ কিংবা ঘটনা সহজেই নিজেদের মধ্যে শেয়ার করেছেন। সংসারজীবনের শুরু থেকে অনেক ঝামেলা তাঁরা একসঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। কম আয় দিয়ে সংসার শুরু হয়েছিল। আত্মীয়স্বজনের টিপ্পনীর কারণ, তাঁদের ছিল পছন্দের বিয়ে। পরিবার মেনে নেয়নি। দুজনই পেশাগত জীবন গড়তে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। ভালোভাবে সন্তানদের বড় করেছেন। আজ এই প্রান্তে এসে দেখলেন, বেলায় বেলায় অনেক সময় কেটে গেছে। এখন নিজেরা কীভাবে বাকি জীবন ঘুরে বেড়াবেন, নিজেদের মতো করে সময় কাটাবেন, সেই পরিকল্পনা করছেন।
কিছু কিছু দম্পতি আছেন, যাঁরা লোকদেখানো সুখের ভান করেন। কোনো কিছুরই অভাব নেই—অভাব শুধু একটু বিশ্বাস, আস্থা আর ভালোবাসার। সন্দেহ, একে অপরের ওপর খবরদারি, নিজেকে জাহির করার প্রবণতাই এঁদের কুড়ে কুড়ে খায়। মার্কিন দাম্পত্য পরামর্শবিষয়ক বেস্ট সেলার লেখক তাহেরেহ মাফি যেমনটা বলেছেন, ‘তোমার সঙ্গীর সুখের জন্য তুমি কিন্তু অক্সিজেন। অক্সিজেন ছাড়া যেমন এই সবুজ গ্রহে বাঁচা অসম্ভব; তেমনি তোমার আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা ছাড়া সঙ্গীর বেঁচে থাকা কঠিন ও অর্থহীন।’
দাম্পত্যজীবনকে অকূলপাথার বলে আখ্যা দেন, এমন লোক কম নয়। কিন্তু সংসার এখন রহস্যময় কোনো দ্বীপ নয়। পুরুষ হলো দেবসম। আর স্ত্রীলোকের মন দেবতার অজানা—এমন সব ভাবনা এই জমানায় অচল। পুরুষ ও নারী এখন একে অপরের পাশে সংসারের প্রতিটি চ্যালেঞ্জে নিত্যসহচর। দুঃখবিলাসী হওয়া একদমই চলবে না।
হতে হবে সুখকামী।
স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যে প্রত্যেকেরই তিনটা করে জীবন থাকে—একটা তাঁর নিজের জন্য, একটা তাঁর সঙ্গীর জন্য, আরেকটি উভয়ের জন্য। এই চমৎকার উপলব্ধি বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী জ্যাকুলিন বিসেটের।
দাম্পত্য জীবনে এমন উপলব্ধিকে যদি সহজে আপন করা যায়, তাহলে সুখ ধরা দিতে বাধ্য। একেকজনের সুখ অবশ্য একেক বিষয়ে। কেউ সঙ্গীর সময় পেলেই খুশি। কারও সুখ নির্ভর করে দামি হোটেলে খাওয়া-থাকা, বিদেশে ঘোরা—এসবে।
ভালোবাসা বনাম ভালোলাগা
ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে কি কোনো তফাত আছে? ভালোলাগা হচ্ছে রাস্তায় চলার পথে কোনো ফুল মনে ধরল, তা ছিঁড়ে নিলেন। শুকিয়ে গেল কিংবা আর ভালো লাগল না; ফেলে দিলেন। আর ভালোবাসা হলো সেই ফুলগাছকে পরিচর্যা করে তাতে ফুল ফোটালেন, পাশে পাশে রাখলেন। আর এই ভালোবাসাই হলো সুখী দাম্পত্যের প্রাণ, মূলমন্ত্র।
দম্পতি শব্দটির মধ্যে কেমন যেন মাধুর্যের ছোঁয়া আছে। মনে হয় দুটি কবুতর মিলে বাকবাকুম করে চলেছে অবিরত। বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসায় দুজনের ছন্দময় আনাগোনা বাসাটাকে আরও মজবুত করে তুলছে। একজনের মুখে খড়কুটো আরেকজন তা দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে মনের আনন্দে। বাচ্চাদের মুখে করে খাওয়াচ্ছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে। শত ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও পাশাপাশি থাকছে। একের বিশ্বাস অন্যের সঞ্জিবনী।
দাম্পত্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর একত্রে সংসারধর্ম পালন। পাশাপাশি থাকা, একে অপরের অনুভূতি বোঝা আর তাতে সাড়া দিতে পারার মধ্যেই রয়েছে সুখী দাম্পত্যের জিয়নকাঠি। সুখী দম্পতির চেহারা ঝকঝকে আয়নার মতো। তাতে দুঃখ-কষ্টক্লেশের ছায়া পড়ে না। নিমেষেই উধাও হয়ে যায়। সমঝোতাপূর্ণ আচরণ তাঁদের জীবনকে আনন্দময় ও সহজ-সাবলীল করে তোলে।
সুখী দাম্পত্যের টিপস
পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন।
পরস্পরের উন্নতি—আত্মিক, আর্থিক, পেশাগত—সব ক্ষেত্রে পাশাপাশি থাকা এবং সমর্থন-সহযোগিতার হাত যথাসম্ভব বাড়িয়ে দেওয়া।
সংসারের সমস্যা নিয়ে সময় দেওয়া, আলোচনা সাপেক্ষে দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। পারস্পরিক দোষারোপ এড়িয়ে চলা।
সংসারের উন্নতির দিকে দুজনের সাধ্যমতো নজর দেওয়া।
পরস্পরের চাওয়া-পাওয়া, ভাললাগা-মন্দলাগাকে সম্মান করা এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া।
চলার পথের কোনো সমস্যাকেই দুরারোগ্য ব্যাধি না ভাবা। এই বিশ্বাস রাখা—সব সমস্যাকেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমাধান সম্ভব।
সঙ্গীর ছোট-বড় চাওয়া-পাওয়া ও অনুভূতিকে মূল্যায়ন করা। তার সুখের স্মৃতিতে সাথি হওয়ার পাশাপাশি দুঃখের সহমর্মী হতে হবে। সুখী দাম্পত্যেও একটা মৌলিক সঞ্জিবনী হলো, সুখী যৌনজীবন। বয়স ও সময়ের বিচারে আকাঙ্ক্ষার পারদের ওঠা-নামা খুবই স্বাভাবিক। পরস্পরের স্পর্শ, ছোঁয়া-প্রযত্ন, কাছাকাছি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বয়েসের কাছে কখনো ফুরিয়ে যায় না। বরং জীবনকে নানাভাবে আবিষ্কার ও উপভোগই হলো কাঙ্ক্ষিত।